প্লাবণভূমি মৎস্যচাষের সাথে ট্যুরিজমে মিলছে অভাবনীয় সাড়া : তৈরী হচ্ছে কর্মসংস্থান

0

‘পুটিয়ায় একটা পার্ক হয়েছে শুনছি, তাই ভাই-বোনদের নিয়ে এখানে ঘুড়তে আসলাম। জায়গাটা অনেক সুন্দর, পানির উপর রেস্টুরেন্ট, নৌকা, রাইডস সব মিলিয়ে হাাতের কাছে একটা ভালো বিনোদন কেন্দ্র হওয়াতে আমাদের জন্য ভালো হয়েছে।’ অপূর্ব প্লাবণভূমি কেন্দ্রিক ট্যুরিজম কেন্দ্রে ঘুরতে এসে তাঁর অভিব্যক্তি এভাবেই প্রকাশ করলেন দাউদকান্দি উপজেলার রায়পুর গ্রামের মোঃ মেহেদী হাসানের। তিনি আরো যোগ করেন-‘এই পার্ক হওয়ার আগে এদিকে ঝোপঝাড় ছিলো, ফলে এখানে বিকেলে বা সন্ধ্যায় কেউ আসতেই চাইতো না। অথচ আজ এখানে মানুষ ঘুড়তে আসে।’

বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার প্লাবণভূমি কেন্দ্রিক মৎস্যচাষ সারাদেশে মডেল। বৃহৎ জলাশয়ে মৎস্যচাষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ব্যপক কর্মযজ্ঞ। কিন্তু করোনা মহামারির সময়টিতে উৎপাদিত মাছের পর্যাপ্ত দাম না পাওয়ায় বেশ ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয় চাষীদের। সেই বিষয়কে মাথায় রেখে প্লাবণভ‚মির সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে সারাদেশের মানুষের কাছে পৌছে দিতে ও বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টিতে সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রকল্পের আওতায় উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে একটি প্লাবণভূমি কেন্দ্রিক ট্যুরিজম কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেয় স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সিসিডিএ।

স্থানীয়দের মধ্যে চা দোকানি আব্দুর রহিম বলেন- ‘আমার ছোট একটা চায়ের দোকানে মানুষ একেবারে আসতেই চাইতো না। স্থানীয় দু একজন চাষী ও বয়স্ক মানুষরাই আসতো, তাও সন্ধ্যা হওয়ার আগেই চলে যেতো। কিন্তু পার্ক হওয়ায় এখন রাত ১০টা পর্যন্ত মানুষ আসা যাওয়া করে এতে পার্কের সাথে আমার দোকানের বিক্রি বাড়ছে, আয়ও বাড়ছে।’ অপূর্ব প্লাবণভূমি কেন্দ্রিক ট্যুরিজম উন্নয়নের কাজ শুরু হয় উপজেলার নিভৃতগ্রাম আদমপুর, পুটিয়া ও বিটমান এই তিন গ্রামের মিলনস্থলে। সিসিডিএর এসইপি প্রকল্প থেকে ঋণ সহযোগিতা গ্রহণ করে ও প্রকল্পের কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তত্বাবধানে। এটি প্রস্তুত কাজে স্থানীয়দের প্রাধান্য দেন উদ্যোক্তাবৃন্দ। সে সময় প্রায় ১৫-২০ জন স্থানীয় শ্রমজীবির কাজের সুযোগ হয়েছে।

অপূর্ব ট্যুরিজম কেন্দ্রে বাঙালী খাবারের পাশাপাশি, সকল রকমের চায়নিজ (ফ্রাইড রাইস, চাওমিন, স্যুপ, চিকেন ফ্রাই ইত্যাদি) ও ফাস্টফুড (ফুচকা, চটপটি, আইসক্রিম, লাচ্চি, কফি, চা, কোমল পানিয় ইত্যাদি) খাবারের রেস্টুরেন্ট, প্যাডেল নৌকা, কায়াক নৌকা, লেজার বোট, নাগরদোলা, মেরিগো রাউন্ড ইত্যাদি সেবাখাত গড়ে উঠেছে। পুরো সেবাখাত তথা পার্ক রক্ষনাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পূর্ণকালীন ও খন্ডকালীন কর্মসংস্থান এর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ২৫-৩০ জনের। যাদের প্রতিজনের আয় প্রতি মাসে ৩-৩০ হাজার টাকা। এছাড়াও এই উদ্যোগ প্রতি সপ্তাহে ৩৯ কেজি প্রায় প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরী হয় যা কেনার ও পুণঃব্যবহারের জন্য স্থানীয় উদ্যোক্তারও সৃষ্টি হয়েছে।

বর্তমানে প্রতিদিন এখানে ৪৫০ জন দর্শনার্থী আসেন অবসর বিনোদনের জন্য। সাপ্তাহিক ছুটি ও বিশেষ দিনগুলোতে আগত দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৬৫০ জন হয়ে যায়। ঈদ, পুজা, নববর্ষসহ জাতীয় দিবস ও সামাজিক উৎসবগুলোতে আগত দর্শনার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১২০০ জন।

এছাড়া পূর্বে অত্র এলাকায় রিক্সা, অটো ভ্যান, সিএনজি চালক ইত্যাদি পেশার তেমন আয় না থাকলেও বর্তমানে অপূর্ব ইকো-ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এই এলাকায় দর্শনার্থীদের যাতায়াত বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলে প্রায় ৩৫-৪০ জন রিক্সা, অটোভ্যান ও সিএনজি চালক আছেন যাদের আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছ। অটোভ্যান চালক মোঃ আবুল, মোঃ হোসেন ও মোঃ ফারুক জানান- ‘আমরা আগে বদলা খাটতাম অনেক কষ্ট হইতো। এই এলাকায় ইদানিং ইলিয়টগঞ্জ, রায়পুর, বাশরা, দৌলতপুর থেকে প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে। আমরা তখন অটো কিনে পুটিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে পার্ক পর্যন্ত ভাড়া টানি। প্রতিদিন মোটামুটি ৭০০-৮০০টাকার ভাড়া টানি। আগের থেকে আমাগো আয়ও বাড়ছে।’

অপূর্ব ট্যুরিজম কেন্দ্রের উদ্যোক্তাবৃন্দ এসইপি প্রকল্প প্রদত্ত পরিবেশগত বিভিন্ন ভালো চর্চা অনুশীলন করছেন। যার মধ্যে অন্যতম হলো- পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, খাবার প্রস্তুতের জন্য যথাাযথ পিপিই ব্যবহার, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাতি ব্যবহার, সোলার প্যানেল ব্যবহার, পানিতে কিছু না ফেলার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, যথাযত সাইন-সিম্বল ব্যবহার, ময়লা ফেলার জন্য বর্জ্যদানি ব্যবহার ইত্যাদি গুরুত্বের সাথে অনুশীলন করে যাচ্ছে যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবেন।

অপূর্ব প্লাবণভূমি কেন্দ্রিক ট্যুরিজম কেন্দ্রের ভাসমান রেস্টুরান্ট।
স্থানীয় পরিবেশ সমাজ ও কৃষি সংগঠক ও জাতীয় পরিবেশ পদক-২০২১ অর্জনকারী অধ্যাপক মতিন সৈকত বলেন- ‘অপূর্ব প্লাবণভূমি ট্যুরিজম কেন্দ্রটি বিকল্প আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি মানুষের অবসর বিনোদনের ব্যবস্থা করেছে। পাশাপাশি আমাদের এলাকার সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ফলে সামাজিক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। যা প্রশংসার দাবী রাখে। সিসিডিএ এসইপি প্রকল্প এই পরিবর্তনের অংশীদার।’


Post a Comment

0 Comments
Post a Comment (0)

Search This Blog

To Top